ডুয়েটের মামুন এখন ফেসবুকের প্রকৌশলী
আবদুল্লাহ আল মামুন পড়েছেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন ফেসবুকের করপোরেট প্রতিষ্ঠান মেটায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। শুনিয়েছেন তাঁর গল্প।
ডুয়েট তখন এক আতঙ্কের নাম। সারা দেশের লাখো ডিপ্লোমা প্রকৌশলী লড়াই করেন এই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। ভাগ্যক্রমে সুযোগ পেয়ে গেলাম ডুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে।
চতুর্থ বর্ষে যখন থিসিস লিখছি, আমার রুমমেটরা তখন জিআরই আর টোয়েফল পড়া নিয়ে ব্যস্ত। আমারও সামনে তিনটি পথ—সরকারি চাকরি, বেসরকারি চাকরি, অথবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা। রুমমেটদের দেখে তৃতীয় পথটাই বেশি টানল। থিসিসের কাজের চেয়ে জিআরইর প্রস্তুতিতেই সময় দিলাম বেশি। কিন্তু হায়। থিসিসে সময় কম দিয়েছি বলে সিজিপিএ কমে গেল। ওদিকে গণিত আর ইংরেজিতে এতই দুর্বল ছিলাম যে জিআরইতেও পেলাম ১৬০০ তে মাত্র ৯৫০। এই নম্বর দিয়ে কোথাও আবেদন করা সম্ভব নয়।
এ বছর ফেসবুকের করপোরেট প্রতিষ্ঠান মেটায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়েছেন মামুন
একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে স্বল্প বেতনে যোগ দিলাম, পাশাপাশি আইইএলটিএসের প্রস্তুতি নিলাম। মাত্র ৬.৫ পেতে আমাকে দুবার পরীক্ষা দিতে হলো। ভাবলাম এমন একটা দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য চেষ্টা করে দেখি, যেখানে জিআরই লাগে না। জার্মানির একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ হলো। সেখানে পড়তেও লাগবে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। অতএব বাদ।
এর মধ্যে বিয়ে করেছি, সংসার করছি। হঠাৎ একদিন ই-মেইল পেলাম সৌদি আরবের কিং ফাহাদ ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ইয়োর অ্যাপ্লিকেশন ইজ কন্ডিশনালি অ্যাকসেপ্টেড’। অর্থাৎ আমি ভর্তি হতে পারব, কিন্তু আবার জিআরই দিতে হবে। হাসিমুখ ম্লান হয়ে গেল। আমি বার্তা পাঠালাম, ‘আবার জিআরই দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই স্কোরেই যদি নেন, তাহলে আমি আগ্রহী।’ ওরা আবেদন মঞ্জুর করল। কিন্তু আবারও শর্ত সাপেক্ষে। প্রথম সেমিস্টারে সিজিপিএ ৩.৫-এর ওপরে থাকতে হবে।
‘সৌদি আরবে কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায়?’ ‘গিয়ে কী করবা, তুমি কি আরবি জানো?’ এমন নানা কথায় কান না দিয়ে চলে গেলাম মরুর দেশে।
রোবটের সঙ্গে আলাপ
সৌদিতে মাস্টার্সের দিনগুলো ভালোই চলছিল। কাজের চাপ এত বেশি যে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ল্যাবেই কাটত। বছরে একটাই ছুটি—গ্রীষ্মে। সেই ছুটিতে সবাই বাড়ি চলে গেল। আমি গেলাম না। পুরো ক্যাম্পাসে ছিলাম আমরা কেবল দুজন। তৃতীয় তলায় আমি, আর নিচতলায় এক নাইজেরিয়ান সিনিয়র।
আমার মাস্টার্স ছিল রোবোটিকস নিয়ে। একা থাকতে থাকতে আমিও বোধ হয় রোবট হয়ে যাচ্ছিলাম। মাঝেমধ্যে একা একাই আমার রোবটের সঙ্গে কথা বলতাম। বাংলাদেশি হোটেল থেকে পুরো এক সপ্তাহের খাবার এনে ফ্রিজে রেখে দিতাম। দিন-রাত চলত থিসিস আর জিআরইর প্রস্তুতি।
এবার জিআরইর ফল কিছুটা ভালো হলো। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে গেলাম। চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির জন্য আবেদন করা শুরু করলাম। তিন মাস অপেক্ষার পর দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ বৃত্তিসহ সুযোগ হলো। তত দিনে বুঝতে পেরেছি, শিক্ষকতা আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু কী করব? চাকরি পেতে হলে কোডিং বা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। আমি জীবনে একবারই প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় গিয়েছি, তা-ও বিনা মূল্যে টি-শার্ট পাওয়ার জন্য।
সাহস করে একেবারে শূন্য থেকে প্রোগ্রামিংয়ের চর্চা শুরু করলাম। ল্যাবের কাজ শেষে রাতে আর ছুটির দিনগুলোকে কাজে লাগাতাম। কয়েক মাস চেষ্টার পর বুঝলাম, এখন আমি ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুত।
একের পর এক প্রত্যাখ্যান
বড় বড় কোম্পানিগুলোতে আবেদন করা শুরু করলাম। শ খানেক আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর বুঝলাম, আমার রিজিউমি আর লিংকডইন প্রোফাইল খুব একটা জুতসই নয়। নানা চেষ্টার পর ইন্টারভিউয়ের ডাক এল ইন্টেল থেকে। দুই দফা ইন্টারভিউ পেরিয়েও চূড়ান্ত পর্বে গিয়ে বাদ পড়লাম। মনে হচ্ছিল, নাহ, এই রাস্তা আমার জন্য নয়।
এরপর একে একে রোকু, ফেডেক্স, নাইকি, স্ট্রাইপ, লিংকডইন, টেসলা, উবার, নানা জায়গায় ইন্টারভিউ দিলাম। প্রতিবারই ইন্টারভিউ ভালো হতো। মনে হতো, এবার হবে। ফলাফল একই। প্রত্যাখ্যান।
হতাশ হয়ে যখন সব ছেড়েছুড়ে দেব ভাবছি, তখনই একটা স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ হলো। এদিকে পিএইচডির শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। কিছুদিন পর ফেসবুক থেকে ইন্টারভিউয়ের ডাক পেলাম। সাত দফায় দীর্ঘ ইন্টারভিউয়ের পর ওরা জানাল, মেটা আপনাকে হেড অফিসে ইফোর সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে চাকরির প্রস্তাব দিতে চায়।
আনন্দে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, আপনার ঘড়িতে যখন সময় হবে, তখন কেউ আপনাকে আটকাতে পারবে না।