•   Friday, 18 Oct, 2024
Cyber Security

‘সাইবার নিরাপত্তা আইন: নিরাপত্তা ও বাক স্বাধীনতার ভারসাম্য কেমন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

Generic placeholder image
  নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীতে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায় আইন বিশেষজ্ঞ, আইসিটি প্রতিনিধি ও মিডিয়া পেশাজীবীরা নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতা রক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলাদেশ সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর জরুরি সংশোধনের আহ্বান জানান। গোলটেবিলে অতিথি ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী এবং  বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইবার নিরাপত্তা আইনটিতে কিছু বিতর্কিত বিষয় থাকলেও, এটি দেশের ডিজিটাল অবকাঠামো রক্ষা, অনলাইন লেনদেনের নিরাপত্তা এবং সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় অপরিহার্য। তারা জাতীয় নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) ও আনোয়ার টেকনোলজিসের যৌথ উদ্যোগে মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন: নিরাপত্তা ও বাক স্বাধীনতার ভারসাম্য কেমন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এই বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। সভায় সভাপতিত্ব করেন টিআরএনবি সভাপতি সমীর কুমার দে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআরএনবি’র সাবেক সভাপতি ও ভিউজ বাংলাদেশের সম্পাদক রাশেদ মেহেদী। বক্তারা বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন বর্তমান ডিজিটাল যুগে অপরিহার্য, যা হ্যাকিং, পরিচয় চুরি এবং সাইবার প্রতারণার মতো ক্রমবর্ধমান হুমকি থেকে সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামো প্রদান করে। এটি আর্থিক ও জ্বালানি খাতসহ গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করে, নিরাপদ ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ বৃদ্ধি করে এবং অনলাইন সেবার প্রতি জনগণের আস্থা আরও সুদৃঢ় করে।

 তারা বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারা যেমন ডিজিটাল বিষয়বস্তু ব্লক করা এবং ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার উদ্বেগ তৈরি করছে। এই আইনটি ভিন্ন মত দমন এবং বাক-স্বাধীনতা সীমিত করার জন্য ব্যবহার হতে পারে। ‘অপপ্রচার ছড়ানো’ বা ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা’ এর মতো অস্পষ্ট শব্দগুলো সাংবাদিক এবং সরকারের সমালোচকদের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। এতে আইনটি নাগরিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং বৈধ অনলাইন অভিব্যক্তিকে দমন করতে পারে। এ কারণে তারা বিতর্কিত ধারা সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছেন। এ সময় সাইবার সুরক্ষা আইন হালনাগাদ করা হচ্ছে জানিয়ে গোলটেবিল আলোচনায় মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না নীতি গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তথ্যপ্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী। তিনি বলেন, সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বড় ইস্যু। আইনের ভাষায় নেতিবাচক কিছু আছে কিনা সেটা দেখতে হবে। আইন নিবর্তনমূলক হওয়া যাবে না। সেলসেন্সরশিপ মানে এমন নয় যেন যা বলার কথা তা আমরা বলছি না। সাইবার সুরক্ষায় করণীয় বিষয়ে সচিব বলেন, ৩৬ জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা বাক-স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। একে অর্থবহ করতে আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। অপর মুখ্য আলোচক বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী বলেন, ডেটা সুরক্ষা ও তথ্য শেয়ারিং’র ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা সহজ নয়। এরমধ্যে রয়েছে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ভেদের দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বাক-স্বাধীনতায় ভারসাম্য রক্ষা। সংস্কৃতি, জাতীয়তার সীমার মধ্যে যদি আমরা দূরত্ব কমাতে পারি তাহলে সমাধান সহজ হবে। এই সমাধানটা নিজেদের মতো করে ‘সেলাই’ করতে হবে। ডিজিটাল অপরাধ শনাক্তের জন্য আইন করতে হবে। কোন প্রযুক্তি আমরা কীভাবে ব্যবহার করবো সেজন্য আগাম চিন্তা করে আগামীতে কোন মূল্যবোধ নিয়ে চলবো, কতোটুকু যন্ত্রের ওপর নির্ভর করবো তা নির্ধারণ করতে পারবো। কগনেটিভ ও টেকনোলজি দুইটি ডোমেইন’র ওপর সাইবার নিরাপত্তা নির্ভর করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুঃখজনক হলো এই দুয়ের মধ্যে শূন্যতা রয়েছে। এটি আমরা নির্দিষ্ট করছি না। 

মূল আলোচনার ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে তথ্য ও প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, স্পেসভিত্তিক অপরাধের জন্য বিচার করাকে আমি অযৌক্তিক মনে করি। অপরাধকে অপরাধের গুরুত্ব ও প্রভাবের মাত্রা অনুযায়ীই বিচার হওয়া দরকার। আসলে নতুন মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণের সক্ষমতা আমাদের দরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে তথ্যের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, আইন করে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রযুক্তি বিভাগ আনোয়ার টেকনোলজিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ওয়ায়েজ আর হোসেন বলেন, ডিজিটাল যুগে সাইবার আইন আরও উন্নত করা অপরিহার্য, কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিরাপত্তা ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা, এবং বিশেষ করে তরুণদের মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, সফটওয়্যার শিল্প ও স্টার্টআপের বিকাশের জন্য উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে মেধাস্বত্বের সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি। রবি’র কোম্পানি সচিব ব্যারিস্টার সাহেদ আলম বলেন, আইনের ছাত্র হিসেবে আমি বুঝি আমাদের দেশে ডিজিটাল ডোমেইন অবকাঠামো বলে কিছু নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬০টি ধারারর মধ্যে ৩৭টি ধারাই ছিল অপরাধ চিহ্নিত করার জন্য। এতে ১৮টি অপরাধ গণ্য করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সাইবার অপরাধের দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে আছে। তবে ই-গভর্নেন্সে আমরা পিছিয়ে আছি। তাই আমাদের কিসের জন্য কোন আইন দরকার তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। আমার মনে হয়, বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করার কিছু নেই। তাই এটি পুরোপুরি বাতিল করে নতুন করে করা উচিত। ডিজিটাল ইকোনোমি যুক্ত করে টেলিকম আইনটিও হালনাগাদ বা নতুন করে করা দরকার। বেসিস সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, বাক-স্বাধীনতায় ভারসাম্য রক্ষায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য স্কুল থেকেই গঠনমূলক সমালোচনা করার সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। এভাবেই সেলফ সেন্সরশিপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

এমটব মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, নতুন আইন করার ক্ষেত্রে অপরাধকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে উপধারাগুলোকে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সংশোধনের সুযোগ রাখতে হবে। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। অপরাধ শনাক্তকরণে বিচারকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। বিডি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার হামিদ বলেন, দেশের আর্থিক খাত খুবই ঝুঁঁকিপ্রবণ। প্রতিদিন দেশের আর্থিক খাতে ৬৩০টি সাইবার আক্রমণ হয়। তাই সাইবার অপরাধ কীভাবে ঘটে তা নির্ধারণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ঠিক করতে হবে। ডেটা সুরক্ষা আইন করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার্যকরভাবে সিকিউরিটি অপারেশন সেন্টার তথা ছক বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি ম্যানেজড ছক গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে দেশে কোনো তথ্য রাখা বাধ্য করতে হবে তা নির্ধারণ করা দরকার। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই নাবিল বি আরিফ বলেন, সাইবার নিরাপত্তার আইনে শাস্তি নয় সুরক্ষাকেই গুরুত্ব দেয়া দরকার। সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার জন্য যে ধরনের কাণ্ড ঘটেছে তা দুঃখজনক। এটা আইনের কাজ নয়। তাই আমাদের আইনের ভাষা পরিচ্ছন্ন ও বোধগম্য হতে হবে। মানুষের নিরাপত্তাকেই সবার ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে যেন তারা ভীত না হন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, অপরাধের ধরন অনুযায়ী অপরাধের ক্ষত তৈরি হয়। এজন্য বিচার বিভাগীয় তদারকি থাকা দরকার। ফেসবুক পোস্ট কন্টেন্ট সংশ্লিষ্ট অপরাধ। এটাই সব নয়। তাই বাক-স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ সাইবার সুরক্ষা আইনে প্রাধান্য পাওয়া উচিত নয়। এ জন্য আমাদের ছাত্র-শিক্ষক-ব্যবসায়ী-জনতার অংশগ্রহণে এই আইন করা দরকার। তা না হলে বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

CCA
Comment As:

Comment (0)