দেশীয় প্রতিষ্ঠান রিভেরির সাফল্যের গল্প
সালটা ২০০৯। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের তিন বন্ধু মো. জাহাঙ্গীর আল জিলানী, মো. জাহিদ হোসেন ও মো. আরিফুল হকের বুয়েটের পাঠ চুকানোর কয়েকমাস বাকি। পাশের বন্ধুরা যখন দেশের বাইরে পাড়ি দেয়ার জন্য জিআরসি, টোফেল দিচ্ছে; বিভিন্ন নামকরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করছে, এই তিন বন্ধুর স্বপ্ন দেশে কী করা যায়, দেশের জন্য কী করা যায়।
স্বপ্ন বড় কিন্তু বাস্তব অনেক কঠিন। তিন বন্ধুই চাকরি করা শুরু করে। পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ কলেজের জন্য একটি কারিগরি কোর্সও তৈরি করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যার পরিচিতি বাড়তে থাকায়, তিন বন্ধুর নিজস্ব কিছু করার সাহসটা আরো বাড়তে থাকে। এ সময় তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় স্বপ্নবিলাসী আরো ৪ তরুণ।
২০১১ সালে এই ৭ জন তরুণ প্রকৌশলী মিলে প্রতিষ্ঠা করেন রিভেরি পাওয়ার অ্যান্ড অটোমেশন ইঞ্জিনিয়ারিং লি.। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ৩৫০ জনেরও বেশি প্রকৌশলী নিয়ে বড় একটি টিম ও খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম হিসেবে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিদ্যুৎ খাতে নানা সমস্যার সমাধান ও বিভিন্ন জটিল প্রকল্প বাস্তবায়ন করে শতভাগ আস্থা অর্জন করেছে। চলুন তাদের সফলতার গল্পটা জেনে নেওয়া যাক।
রিভেরির উদ্যোক্তারা বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করার সুবাদে একটি বিষয় লক্ষ্য করেন যে, দেশে প্রচুর বিদেশি প্রকৌশলীরা কাজ করেন। মেধায়, উদ্যমে দেশীয় প্রকৌশলীরা কোনো অংশেই কম নন, কিন্তু এমন কোনো দেশীয় প্রতিষ্ঠান নেই যারা গ্রাহক পর্যায়ে সেই আস্থা অর্জন করেছে। এই লক্ষ্য নিয়েই রিভেরির যাত্রা শুরু।
২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসলে দেশের বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু হয়। সেসময় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৩,৩০০ মেগাওয়াট, যা এখন প্রায় ২৫,০০০ মেগাওয়াটেরও বেশি। এই সময় যে শুধু পাওয়ার জেনারেশনে উন্নয়ন হয়েছে তা নয়, বরং ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশনেও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এর পাশাপাশি বিদ্যুৎ নির্ভর প্রচুর কলকারখানা গড়ে উঠেছে।
বিদ্যুৎ খাতের এ উন্নয়নে রিভেরির প্রযুক্তিগত ব্যাপক অবদান রয়েছে। পাওয়ার সিস্টেমের পাশাপাশি কন্ট্রোল সিস্টেম, ডিস্ট্রিবিউটেড অটোমেশন সিস্টেম, স্ক্যাডা কমপ্লেক্স, গ্রিড সিনক্রোনাইজেশন ইত্যাদি অনেক জটিল প্রকৌশলী সমাধান সম্পূর্ণ দেশীয় প্রকৌশলী দ্বারা এখন পর্যন্ত শুধু রিভেরি দিয়ে থাকে। আর এই জটিল প্রকৌশলী সমাধানগুলো বিদ্যুতের উৎপাদন থেকে শুরু করে গ্রাহক পর্যায়ে প্রায় প্রতিটি খাতে লাগে।
শুধু প্রযুক্তিগত সমাধানই নয়, রিভেরি আন্তর্জাতিক মানের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও সুইচগিয়ার তৈরি করছে। রিভেরির তৈরি ট্রান্সফরমার স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক ল্যাব থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ফলে তাদের এই ট্রান্সফরমার ও সুইচগিয়ারগুলো বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সরবরাহ হচ্ছে।
এ বিষয়ে রিভেরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আল জিলানী বলেন, ‘দেশের জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরি, আমদানি নির্ভরতা কমানো ও রপ্তানি বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের যে অসামঞ্জস্যতা তা রোধ করা সম্ভব। সারাবিশ্বেই বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির গ্রাহক বেড়ে চলছে, আর এই চাহিদা সবসময় থাকবে। আরএমজি সেক্টরের পাশাপাশি এই খাতও আমাদের অর্থনীতিতে অনেক বড় অবদান রাখতে পারে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন দেশে আমাদের পণ্যগুলো রপ্তানি করতে আমরা বদ্ধপরিকর।’
রিভেরির চেয়ারম্যান মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা দেশের বিদ্যুৎ খাতের অন্যান্য ছোট-বড় ম্যানুফ্যাকচারারদের নিয়ে পণ্যের গুণগত মান বজায় রেখে একে অপরের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই লক্ষেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আরিফুল হক বলেন, ‘রিভেরি সম্পূর্ণ দেশীয় মেধানির্ভর তরুণ প্রকৌশলীদের প্রতিষ্ঠান।আমরা প্রমাণ করতে চাই, আমরা শুধু শ্রমিক নির্ভর দেশ না; মেধামননে আমরা কারো চেয়ে পিছিয়ে থাকবো না।’
এই ৩ পরিচালক ছাড়াও অন্যরা হলেন মুস্তাজাব হোসেন, আব্দুর রহমান, এ বি সিদ্দিক, এস এম ফয়সাল। নিজেদের দক্ষতা ও মেধা কাজে লাগিয়ে রিভেরি দেশীয় পর্যায়ে অনেকগুলো জটিল প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেছে, যা কয়েক বছর আগেও বিদেশিরা ছাড়া কেউ করতে পারতো না। গোপালগঞ্জ ইন্টেরিম ৪০০/১৩২ কেভি ৬৫০ এমভিএ সাবস্টেশন, দেশ এনাৰ্জি ২০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টসহ সরকারি, বেসরকারি বহু মাইলফলক প্রকল্প রিভেরির মুকুট উজ্জ্বল করেছে।
পরিচালক আব্দুর রহমান বলেন,দেশের সার্বিক বিদ্যুৎ উন্নয়নে বিস্তর ভূমিকা পালনকারী রিভেরির আকাশছোঁয়া অগ্রগতি বর্তমান অনেক দেশীয় দালাল ও বিদেশি কোম্পানির জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই রিভেরির চলমান ও ভবিষ্যৎ কর্ম-পরিকল্পনার মধ্যে ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও মাথায় রেখে কাজ করতে হচ্ছে। দেশের অদম্য অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে এমন ষড়যন্ত্র আগেও হয়েছে, আরও হতে পারে; এর মধ্যেই এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
সমাজবিজ্ঞানী ড. আসিফ আবেদ বলেন, এই তরুণরা চাইলে দেশের বাইরে গিয়ে নিজেদের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে পারতেন, তারা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাদের প্রতিষ্ঠানে, যা দেশের উন্নয়নেই অবদান রাখছে। আমরা তো এমন তরুণদেরই চাই যারা দেশের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নেও কাজ করবে।